সাবিনাদের বিদ্রোহ, মাইনাস ফাইভ, অত:পর সেই বাটলারেই ইতিহাস
দেড় বছরে চিত্রটা কত পাল্টে গেছে। সময়ের হিসাবে দেড় বছর। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই অনেক ঘটনা ঘটেছে মেয়েদের ফুটবলে। মেয়েদের ফুটবলের সঙ্গে গোলাম রব্বানী ছোটনের সঙ্গে ১১ বছরের সম্পর্ক ছেদ। ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলারের দায়িত্বগ্রহন। সাফে জাতীয় নারী দলের দ্বিতীয় শিরোপা জয়। ব্রিটিশ কোচের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। জাতীয় দল থেকে মাইনাস ফাইভ। অত:পর ইতিহাসের পাতায় দেশের নারী ফুটবল ও পিটার জেমস বাটলার।
ছোটনের ভূমিকায় পিটার
২০২৪ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোচ হিসাবে চলে যান গোলাম রব্বানী ছোটন। সাবিনাদের সঙ্গে দীর্ঘ ১১ বছরের সম্পর্ক ছেদ করতে এতটুকু সময় নেননি ছোটন। দিশেহারা বাফুফে একাডেমির কোচের পদ থেকে সরিয়ে এনে জাতীয় নারী দলের দায়িত্ব দেয়। তখন অনেকেই মনে করেছিলেন এবার আর সাফে শিরোপা জেতা হবে না সাবিনাদের।

মাঠে সহকারী কোচ মিরোনার সঙ্গে আলাপরত কোচ পিটার
সাফে কোচ-খেলোয়াড় বিবাদ
গত বছর কাঠমান্ডুতে খেলতে গিয়ে কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন সাবিনা খাতুন, মনিকা চাকমারা। কোচ আর খেলোয়াড়দের মধ্যো একটি মানসিক দ্বন্দ্বও শুরু হয়। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার ভাজ পড়ে হাজার মাইল দূরে বসে থাকা ঢাকায় বাফুফের কর্তাদের কপালে। তবে সাবিনা বলেছিলেন, ‘আমরা শিরোপা জিততে এসেছি। সেটা করেই ফিরব। কি হয়েছে, তা পরে বুঝা যাবে।’ সেই কথাই রেখেছিলেন সাবিনা। কাঠমান্ডু থেকে সাফের দ্বিতীয় শিরোপাও জিতে এনেছিলেন।
ঢাকায় বিদ্রোহ
ঢাকায় ফেরার পর এ বছরের ৩০ জানুয়ারি কোচের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেন অধিনায়ক সাবিনা খাতুনসহ ১৮ নারী ফুটবলার। কোচের পদত্যাগের দাবীতে তারা অনুশীলন বয়কট করেন। এ নিয়ে হইচই পড়ে যায় দেশজুড়ে। তবে সাবিনারা ক্যাম্পে বসে থাকলেও পিটার জুনিয়রদের নিয়েই অনুশীলন করেন। শুধু তাই নয়, ইংরেজি ভাষায় মাতসুশিমা সুমাইয়া একটি চিঠিও লেখেন বাফুফের কর্তাদের কাছে। যা কোচের কানেও যায়। যদিও ক্যাম্প বর্জন থেকে সরে আসার জন্য মহিলা উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরন নানা দিক দিয়ে চেষ্টা করেছেন।

কোচের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দিনে সাবিনাসহ ১৮ ফুটবলার
কৌশলী পিটারের ‘খোলা দরজা’
কোচের পদত্যাগ চেয়ে বিদ্রোহ করা ফুটবলারদের বিষয়ে মুখে ‘রা’ করেননি বাটলার। তবে তিনি আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে বিদ্রোহ করা ঠিক হচ্ছে না। তারা যদি চায়, তাহলে বিদ্রোহ পরিহার করে অনুশীলন মাঠে ফিরতে পারে। সেই সঙ্গে বিদ্রোহের নাটের গুরুদের ক্ষমা না করার ইঙ্গিতও দেন।
বাটলারের ‘মাইনাস ফাইভ’
জাতীয় দল গঠনের আগেই ভুটানে নারী ফুটবল লিগের তিনটি ক্লাবে পাঠানো হয়েছে জাতীয় নারী দলের ১০ ফুটবলারকে। পরবর্তীতে এর মধ্য থেকে মাত্র পাঁচজনকে জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাকেন ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলার। বাকি পাঁচজনকে ডাকেননি তিনি। তারা সবাই সিনিয়র খেলোয়াড়। আর কখনোই ডাকেননি তিনি। এভাবেই জাতীয় নারী ফুটবলে ‘মাইনাস ফাইভ’ নীতি গ্রহণ করেন বাটলার।
ঋতুপর্ণা চাকমা, রুপনা চাকমা, শামসুন্নাহার সিনিয়র, মনিকা চাকমা ও মারিয়া মান্দা ঢাকায় ফিরে ক্যাম্পে যোগ দেন। কিন্তু তিনি ঢাকায় ফেরাননি সিনিয়র চার ফুটবলার সাবিনা খাতুন, মাসুরা পারভীন, সানজিদা আক্তার ও কৃষ্ণা রানী সরকার এবং জাপানি বংশোদ্ভূত মাতসুশিমা সুমাইয়া।

কোচ বাটলারের পাশে সাবিনা। এই দৃশ্য হয়তো আর দেখা যাবে না
মাইনাস ফাইভেই কি সাফল্য?
শক্ত হাতে বিদ্রোহ দমন করে যেন চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় ছিলেন ব্রিটিশ পিটার বাটলার। এই মেয়েদের দিয়েই তিনি সাফল্য কুড়িয়ে আনতে চাইছিলেন। হয়েছেও তাই। জুনে মিয়ানমারে নারী এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের প্রস্তুতির জন্য ২৭ মে জর্ডানে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট খেলে বাংলাদেশ নারী দল। আফঈদা খন্দকারের নেতৃত্বে ওই সফরে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে গোলশূণ্য ড্র করে এবং জর্ডানের বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্র করে। জুলাইয়ে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত এএফসি নারী এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাহরাইনকে ৭-০ গোলে, স্বাগতিক মিয়ানমারকে ২-১ গোলে এবং তুর্কমেনিস্তানকে ৭-০ গোলে হারিয়ে ইতিহাসে প্রথমবার এশিয়ান কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জণ করে সিনিয়র দল।
এবার সেই আফঈদা খন্দকারের নেতৃত্বে এবং পিটার বাটলারের অধীনে এএফসি অনূর্ধ্ব-২০ নারী এশিয়ান কাপ বাছাই পর্ব পেরিয়ে গেছে বাংলাদেশ। মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে আরেকটি ইতিহাস গড়ল লাল সবুজের মেয়েরা। লাওসে সদ্য শেষ হওয়া টুর্নামেন্টের এইচ গ্রুপে বাংলাদেশ স্বাগতিকদের ৩-১ গোলে এবং তিমুরলেস্তেকে ৮-০ গোলে হারিয়েছিল। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ৬-১ গোলে হারলেও সেরা তিন রানার্সআপের মধ্যে একটি হয়ে চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ।
সিনিয়র খেলোয়াড়দের বিদ্রোহের নিশানা হয়েও বাংলাদেশের নারী ফুটবলকে নতুন করে লিখলেন এক ব্রিটিশ কোচ। পরিণতি কি তাহলে? মাইনাস ফাইভ স্থায়ীই হবে?
ওএফ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: